ইন্টারনেট অব থিংস


এটা আবার কী জিনিস? খায় না মাথায় দেয়? নাকি গায়ে মাখে? হুরু মিয়া কী নিয়া আইছেন, যন্ত্রপাতির সাথে ইন্টারনেট, এটা আবার নতুন কিছু? আমার দূরালাপন যন্ত্র, যন্ত্রগণক সবকিছুতেই তো ইন্টারনেট আছে আর কী?

 

ইন্টারনেট অব থিংস কী জিনিষ?

আমরা যা কিছু দেখি, করি বা বিবেচনা করি, তা একটা সেন্সর দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সেটাকে একটা ডিজিটাল ডাটায় রূপান্তরিত করা হয়। তারপর সেই ডাটাকে পর্যবেক্ষণ করে একটা গাইডলাইন তৈরি করে সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নেয়াই হচ্ছে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’র কাজ। মানে আমাদের নিত্য সবকিছুতে আমাদের হয়ে সেখানে কমান্ড দেয়া, সেই সাথে সেটা বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে ইন্টারনেট অব থিংসের কাজ।

অর্থাৎ কোন পরিবর্তনকে পর্যবেক্ষণ করা, প্রসেস করা, সিদ্ধান্ত তৈরি করা, সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সিস্টেমের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যকে পরিচালনা করা, সংরক্ষণ, ভিজুয়ালাইজেশন এই সবগুলো বিষয়কে সমন্বিত করে যে নতুন ধারণা প্রবর্তিত হয়েছে, তাই হচ্ছে ইন্টারনেট অব থিংস বা IoT.

 

কেন ইন্টারনেট অব থিংস?

রহিম সাহেব বয়স্ক মানুষ, সেই সাথে নানান রোগের রোগীও। ক্ষণে গরম লাগে আবার ক্ষণে ঠান্ডা লাগে, এই ফ্যান চালাও আবার হিটার চালাও, এসি চালাও এইগুলা বকতে বকতে তার দিন যায়। আর এই কাজ গুলা করার জন্য তিনি সমরকে তার বাসায় নিয়োগ দিয়েছেন, মোটা অঙ্কের বেতনও দেন। কিন্তু সমর কী করে? এই ফ্যান ছেড়ে গেলো তো গেলোই, আর তার কোন খোঁজ নাই। ডাকতে ডাকতে রহিম সাহেবের ডায়াবেটিস লেভেল হাই হয়ে যায়, প্রেসার বেড়ে যায়, রাগ জমে যায় আরো কত কী হয়ে যায়, কিন্তু সমরের এদিকে খেয়ালই নেই। সে তার কাজের প্রতি একটুও দায়িত্বশীল না। এমন অবস্থায় রহিম সাহেবের ছেলে চিন্তা করলো, যদি সবকিছু অটোমেটেড হতো, তাহলে কেমন হতো? আব্বার যখন ঠান্ডা লাগবে, তখন অটো হিটার চালু হয়ে যাবে; যখন গরম লাগবে, তখন অটোম্যাটিক ফ্যান চালু হয়ে যাবে; আবার যখন বেশি গরম লাগবে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসি চালু হয়ে যাবে। কত সুবিধা, তাই না?

 

ইন্টারনেট অব থিংস বা IoT এর ক্ষেত্রে সেন্সর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পরিবেশ থেকে ডাটা সংগ্রহ করে ওয়্যার কমিউনিকেশন, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (RF), সিরিয়াল কমিউনিকেশন (UART) বা সিরিয়িাল পেরিফেরাল ইন্টারফেস (SPI) ইত্যাদি কমিউনিকেশনের মাধ্যমে লোকাল প্রসেসিং  ডিভাইসে ডাটা প্রসেস করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন কমিউনিকেশন প্রটোকল- যেমন HTTP, MQTT, Wifi, Bluetooth ইত্যাদি ব্যবহার করে ওয়েব সার্ভার বা ক্লাউড সার্ভারে পাঠানো হয়। সার্ভারে বা ক্লাউড সিস্টেমে ডাটাবেজে ডাটাসমূহ জমা থাকে। ডাটা এনালাইটিক্সের মাধ্যমে সেন্সর থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন সময়ের ডাটা প্রসেস করা হয় এবং সিস্টেম থেকেই ফলাফল ফিল্টারিং করে সিদ্ধান্ত বা কমান্ড তৈরি করা হয়, যা দ্বারা পরস্পর সংলগ্ন বা ডিপেন্ডেন্ট অন্যান্য সিস্টেমকে পরিচালনা করা হয়। ডাটা ভিজুয়ালাইজারের মাধ্যমে গ্রাফিক্যালি বা পরিসংখ্যান আকারে রিপোর্ট প্রদর্শন করা হয়। সমস্ত প্রক্রিয়াটি অনলাইন-নির্ভর হওয়ায় দূর থেকেই সিস্টেমে কমান্ড পাঠানোর মাধ্যমে  নিয়ন্ত্রণ, স্ট্যাটাস ভিজুয়ালাইজ করা, চালু করা, বন্ধ করা সবই করা যায়। যেমন ঘরের তাপমাত্রা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ, অটোমেটিক পানির পাম্প নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।

কেমন হয় যদি বাজারের লিষ্টটা অটো জেনারেট হয়? আর যদি লিষ্ট তৈরি করার সময় আপনার পছন্দ-অপছন্দ, বাসায় কী কী আছে, কী কী নেই, পুষ্টিগুণ ইত্যাদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা, তাই না?

সোজা বাংলায় কাজ ফাঁকি দেয়া সমর…….  তোমার চাকরি বাতিল, তোমার কাজ এখন অটোম্যাটিক হবে, তোমাকে বেতন ‍দিয়ে রাখতে যাবো কোন দুঃখে?

প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এখন অন্যান্য অনেক কিছুই হয়ে পড়ছে স্মার্ট; মানে বেশ ভালো রকমের ছোট্ট একটা কম্পিউটার ভরে দেয়া যায় টিভি, ফ্রিজ, গাড়ি, এমনকি দরজার তালাতেও। আর নেটওয়ার্কিং প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এই নতুন স্মার্ট ডিভাইসগুলা ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হতে পারে। কিন্তু ফ্রিজকে ইন্টারনেটে যুক্ত করে লাভটা কী? ওর কি ফেইসবুক একাউন্ট হবে নাকি!! নাহ, তা না, তবে সুবিধাটা হলো এই সব যন্ত্রপাতি এখন নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারবে, আর অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে যোগাযোগ করে স্মার্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। উদাহরণ দেই- বাজার করতে হবে? ফ্রিজ খোলার দরকার নাই, আপনার ফ্রিজ নিজেই ভিতরে কী আছে তা জেনে আপনাকে বা আপনার স্মার্টফোনকে জানিয়ে দেবে। অথবা ভবিষ্যতের ফ্রিজ সরাসরি অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কিনে ফেলতে পারবে। আপনার কাজ কমে গেলো, বাজারের ফর্দটা আর হারিয়ে ফেলে চুলকাতে হবে না মাথা। রান্নার রেসিপি আর মনে রাখতে হবে না, রেসিপিটা চুলায় ডাউনলোড করে দিলে চুলাই করবে রান্না। বাড়ির দরজার চাবি লাগিয়েছেন কিনা মনে পড়েনা? স্মার্টফোনের একটা এপ্লিকেশন দিয়ে অফিসে বসেই লক করতে পারবেন। ঘরের বিদ্যুৎ বিল নিয়ে চিন্তিত? লাইটবাল্ব ঘরে কে আছে, বাইরের আবহাওয়া কিরকম তা অটোমেটিক্যালি চেক করে পারবে উজ্জ্বলতা বাড়াতে কমাতে। রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালাচ্ছেন… রাস্তাটা সামনে একটু ভাঙা আছে, মাইল খানেক পরে ট্রাফিক জ্যাম? স্মার্ট রাস্তা বা ব্রিজের কাছ থেকে অনায়াসে আপনার ফোন বা আপনার স্মার্ট চশমায় তথ্যটা চলে আসবে।

sensors-for-iot

ধরি ভোলারাম আর অলসরাম দুজনেই একই সাথে থাকেন। নাম যেমন তাদের কাজও তেমন, ভুলারামের কাজ হচ্ছে ভুলে যাওয়া আর আর অলসরামের কাজ হচ্ছে সবকিছুতেই আইলসামি করা, এমতাবস্থায় ভোলারামের কাঁধে দায়িত্ব পড়লো বাজার-সদাই আনার। তার নামের কোয়ালিটি বজায় রাখতে তিনি কোনরূপ কার্পণ্য না করে বাজারে যাওয়ার পথে সবই ভুলে গেলেন। এখন কী করা? বাজার থেকে ফেরত আসা! আবার গিয়ে যে ভুলবেন না সে বিষয়েও তিনি নিশ্চিত নন, তাহলে করণীয় কী? এবার তার ফ্রিজের সাথে কানেক্ট হয়ে তিনি স্মার্ট সানগ্লাসে দেখে নিলেন তার ফ্রিজে কী কী আছে আর কী কী নাই। তারপর তার রান্না ঘরের বাজার-সদাই রাখার যে কন্টেইনার আছে, সেটাতে কানেক্ট হয়ে দেখে নিলেন সেখানে কী কী নাই। এবার দোকানিকে বলতে যাবেন, এমন সময় তিনি আবার ভুলে গেছেন। এখন কী করা? এখন তিনি তার ক্লাউড ডিভাইসকে কমান্ড দিলেন হারামজাদা জানিস্ না আমি ভুলে যাই? দোকানের প্রিন্টারে পাঠিয়ে দে। সাথে সাথে তার বাজারের লিষ্টটা প্রিন্টারের কাছে চলে আসলো, প্রিন্টারের কাজ প্রিন্ট করা, সেহেতু সেখানে মেশিন সিদ্ধান্ত নিবে এই ডাটা প্রিন্ট করতে হবে। তারপর সেটা প্রিন্ট হয়ে চলে আসলো, তিনি সদাইপাতি নিয়ে চলে আসলেন। এবার বাবা অলসরামের পালা। পালাবি কোথায় রে অলসরাম?

ইন্টারনেট অব থিংস কী শুধুই ভোলারামের জন্য?

এবার অলসরাম কমান্ড পাঠালেন, আমার চাল হবে দুমুঠো। সেগুলো ভালোমতো পরিস্কার হবে, তারপর রান্না হবে, একেবারে পার্ফেক্টভাবে হতে হবে, কোন হেলা ফেলা চলবেনা। অন্য চুলাকে বললেন তুই কি বইসা থাকবি? তুই ফ্রিজ থেকে দা‘র কাছে তরকারি পাঠিয়ে সেটা পরিমাণ মত কাঁটাছেড়া কর। কন্টেইনারকে বল প্রয়োজনমত সবধরণের মসলা দিতে। তারপর হাঁড়িকে বলবি ভালোমতো পরিস্কার হয়ে সবকিছু নিয়ে তোর কাছে চলে আসতে। এবার ভালোমতো রান্না করতে থাক্। রান্না হয়ে গেলে আমার স্মার্ট গ্লাসে খবর পাঠিয়ে দিস্।

এবার খেলারাম খেলে যা, ভোলারাম ভুলে যা। অলসরামও ইচ্ছামতো আইলসামি করতে থাক।

 

যেভাবে কাজ করে :

ইন্টারনেট অফ থিংস হচ্ছে , সব ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রগুলোকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নেটওয়ার্ক – ইন্টারনেট-এর সাথে যুক্ত করা। এটা করার জন্য সব যন্ত্রের একটি করে আইপি এড্রেস লাগবে, IPv6 এই কাজটি করবে। সব যন্ত্রগুলোকে একই নেটওয়ার্কে থাকার সুবিধা হবে অনেক বেশি, একটি নির্দিষ্ট যন্ত্র দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, যেহেতু সবাই একই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এখন যেমন 2জি মোবাইলও 3জিতে কাজ করে না, ইন্টারনেট অফ থিংস এইসব সমস্যা দূর করে দিবে। একটা প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চাইলে আমেরিকার একটা ফ্রিজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কেউ ভুল করে বাড়ির দরজা খোলা রেখে গ্রামের বাড়িতে চলে গেলে, তার মোবাইল ফোন দিয়ে বাড়ির দরজাটা বন্ধ করা যাবে… কারন সবাই একই নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত, ইন্টারনেটের সাথে।

 

তথ্যসূত্র : Internet of Things with Intel Galileo

রাগীব হাসান (সহকারি অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অফ আলাবামা অ্যাট বার্মিংহাম)

অসীম কুমার পাল (a2i Bangladesh)

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.