আজ আমার রেজাল্ট বেরোবে, আমি গোল্ডেন এ প্লাস পাচ্ছি সেটা আমি যেমন নিশ্চিত তেমনি আমাকে যারা চেনে সকলেই নিশ্চিত। ব্যাপারটাতে আমার বিন্দুমাত্র এক্সাইটমেন্ট কাজ করতেছে না। কখন বেরোবে সেই সময়টাও আমার দেখার কিংবা জানার প্রয়োজন পড়তেছে না।
সেই ক্লাস সিক্স থেকে গোল্ডেন এ প্লাস পেতে পেতে আমি অতিষ্ট।
মানুষজন এই রেজাল্ট নিয়ে যতটা আনন্দিত হয় কিংবা এর কম রেজাল্ট পেয়ে যতটা আনন্দিত হয় আমি তারও বেশী ব্যথিত হই।
আমার কাছে সেই ক্লাস ওয়ান থেকে তিন বছরে ক্লাস টুতে টেনে-টুনে কোনোমতে উঠার আনন্দটা বেশীই ছিল, পাড়া প্রতিবেশী কিংবা স্যারদের হাসির পাত্র হওয়ার দৃশ্যটাই ছিল আমার জন্য বেশ আনন্দের।
আমি সবসময়ই চাই নিজের মতো করে বাঁচতে, আমার যা আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে। কিন্তু সেটা আর পারা হয়ে উঠে না। মেকি স্কিল মেকি রেজাল্ট মেকি মেধা এসবের কিছুই আমার ভালো লাগে না।
আমার জন্মের সময়ে আমার মা মারা গেলে বাবা আর দ্বিতীয় বিয়ে করতে যান নি আমার কথা ভেবে, আমার কিছু হলে কিংবা আমাকে কেউ কিছু বললে সেটা বাবার সহ্য হত না। বাবা সবসময়ই আমাকে আগলে রাখতেন, আমার যখন যা প্রয়োজন হত তাই দিতেন। চাওয়ার আগেই পেয়ে যেতাম আমি। জন্মের পর থেকে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমার দিকে কেউই আঙ্গুল তোলার কিংবা কিছু বলার সাহস দেখাতে পারেনি।
যখন প্রাইমারিতে ভর্তি হলাম, তিন মাস পর স্যারেরা আমার বাবাকে কল করলেন, আমার সেমিস্টার রেজাল্ট দেখানোর জন্য, বাবা আমার প্রত্যেকটা সাবজেক্টে ০০ দেখে এলেন। দ্বিতীয় সেমিস্টারেও একই রেজাল্ট এবং ফাইন্যালের রেজাল্টেও কোনো উন্নতি হল না।
এ নিয়ে বাবাকে স্যারদের অনেক কটু কথাও শুনতে হয়েছিল, পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি আত্মীয়-স্বজনদের কেউই আমাকে নিয়ে টাট্টা করা থেকে বাদ যাননি।
পরপর তিনবছর একই রেজাল্ট নিয়ে একই ক্লাসে থাকতে হয়েছিল আমাকে।
তারপর স্যারদের দয়া পরবশে একটা ক্লাস উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। সেই একই কাহিনী ক্লাস টু-তেও। এভাবে আমার সময়টা বেশ ভালোই যাচ্ছিলো, বাবার প্রতি আমার কোনো অভিযোগও ছিল না কোনোদিন কিংবা এ নিয়ে আমার কোনোদিন আফসুসও হয়নি।
আমার এক ফুফু থাকতেন আমেরিকার নর্থ ডাকুটাতে, বাবা ফুফুর সাথে দেখা করার কথা বলে আমাকে সেখানে নিয়ে গেলেন। আমরা যখন ডাকুটাতে পৌছাই তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছিল।
সেখানকার এক মেডিকেল কলেজে আমাকে নিয়ে উঠলেন বাবা, বাবা ডাক্তার হওয়ায় এ বিষয় নিয়ে আমার তেমন একটা জানার আগ্রহ জন্মায়নি, সেখানকার অনেকে বাবার সাথে কী জানি শব্দে কথা বললেন বাবাও তাদের সাথে তাদের শব্দে কথা বলে চললেন। কেউ কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে কী জানি বললেন আমি বুঝিনি তাই আমি চুপ থেকে গেলাম।
ওখানে বাবার ল্যাবরেটরির মতো একটা রুমে আমাকে নিয়ে গেলেন বাবা, তখনও আমি বুঝতে পারিনি আমার সাথে কী হতে চলছে।
আমাকে একটা চেয়ারের মধ্যে বসতে বলে বাবা রুম থেকে কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়ে গেলেন, যখন আসলেন তখন তার গায়ে মেডিকেলের ইউনিফর্ম পড়া হাতে হাবিজাবি কী-সব জিনিসপত্র। বাবা এসে আমাকে হেলান দিয়ে বসতে বলে আমার সীটের নিচ থেকে বেল্ট তুলে সেগুলো দিয়ে আমাকে প্যাচিয়ে নিলেন। তারপর সুইচ টিপতেই চেয়ারটা আস্ত একটা খাটে পরিণত হয়ে গেল। বসা থেকে আমি অটোম্যাটিক্যালি শোয়ার পর্যায়ে চলে গেলাম, তারপর বাবা আমার নাকের সামনে একটা বাক্স ধরে বললেন বাবা দেখো তো এটার গন্ধ কেমন?
আমি সরল মনে বাবার কথায় নাক দিয়ে টান দিই……..
যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন আমি আমার ফুফুর বাসায়.
তিনমাসের আমেরিকা সফর শেষে যখন আমরা দেশে ফিরলাম তখন ডিসেম্বর মাস চলে, পাড়া প্রতিবেশী সকলেই টিটকারী করার জন্য জানতে চাইলেন আমার পরীক্ষার রেজাল্ট কী, আমি পরীক্ষা দিয়েছিলাম কী না এই সব হাবিজাবি প্রশ্ন করতে থাকলেন আমাকে এবং বাবাকে।
এর আগে বাবা অনেকটা নরম থাকলেও এবার বাবা তাদের সাথে টিটকারী যোগ দিলেন এবং আমার দুর্বলতাটাকে বাবা সবলতার স্বরুপ তাদের সাথে টাট্টা করে যেতে লাগলেন।
যথারীতি জানুয়ারী মাস আসলে আমাকে ভর্তি করার জন্য বাবা স্কুলে নিয়ে গেলেন, আমাকে ভর্তি নিতে কেউই রাজি হননি, আমাদের পার্শ্ববর্তী স্কুলেও আমার ভর্তি নেয়া হয়নি।
বাধ্য হয়ে বাবা আমাকে নিয়ে শহরের একটি নামকরা স্কুলে ভর্তি করার জন্য নিয়ে গেলেন সেখানে তাদের নিয়মানুযায়ী আমাকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ভর্তি হবে।
পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলে নিজের ফলাফলে নিজেই মুগ্ধ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না, প্রধান শিক্ষক প্রথমেই অফার করে দিলেন আমার কোনো টিউশন ফি লাগবে না, আমার টিফিনও স্কুলের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করা হবে।
আমার আনন্দের আর সীমা নাই, গ্রামের স্কুলের শিক্ষকদের রীতিমতো বকাঝকা করতে ইচ্ছে করলেও তখন চুপ থেকে গেলাম।
গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই আমি আই.বি এমে চাকরী পেয়ে যাই, আইবিএম আমার লেখাপড়া চলাকালীন সময়ে আমাকে শুধু স্যালারীই দিয়ে যাবে বিনিময়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর তাদের কোম্পানিতে জয়েন করতে হবে।
আমার প্রাইমারী সহপাঠীদের অনেকেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরীর পিছনে ঘুর ঘুর করতেছে আর আমার কি-না গ্র্যাজুয়েশনের তিন বছর আগেই চাকরী রেডি তাও আবার কোনো প্রকার কাজ কর্ম্ম ছাড়াই বেতন ভোগ করে যাচ্ছি। ব্যাপারটা আমার কাছে মোটেও আনন্দের না, আমার বরং কষ্ট হচ্ছে নিজের মতো থাকতে না পারার জন্য, বাবাকে আমার ঘৃণা করতে ইচ্ছে করতেছে। সবাই যার যার ব্রেইনের ব্যবহার করতেছে আর আমি একটা চিপসের সাহাজ্যে অভার ট্যালেন্টেড হয়ে বাস করতেছি।
বাবা মারা যাওয়ার পর, বাবার ল্যাপটপটা আমি নিজেই ব্যবহার করা শুরু করি, একদিন বাবার মেইলে লগিন করলে দেখতে পাই আমেরিকান এক ডক্টর আমার ব্যাপারে আর আমার মাথায় থাকা চিপসের ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন, ব্যাপারটাতে আমার কৌতোহল জাগলে আমি আমার পার্সোনাল মেইল থেকে সেই ডাক্তারকে মেইল করে জানতে পারলাম- আমাকে নিয়ে টিটকারী করা বাবার যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে পড়ে তখন বাবা অসহ্য হয়ে আমার মাথায় একটা চিপস লাগিয়ে দেন, যেটা এমএল এর পাওয়ারে চলবে , প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিয়ে দিন দিন আরো শক্তিশালি হতে থাকবে, আমার যখন কোনো কিছু মনে করার প্রয়োজন পড়বে অথবা জানার প্রয়োজন পড়বে তখন আমার মাথায় থাকা চিপস নিজে নিজে নেট থেকে ডাটা কালেক্ট করে আমার চোখের সামনে তুলে ধরবে, আর আমি হড়হড় করে সেটা বলে দেব। উল্লেখ্য যে আমার ব্রেইনের সেলগুলোর তেমন একটা ব্যবহার সম্ভব হয়ে উঠেনি, আমার ব্রেইনের সেলগুলোর ৯৯.৯৯% অব্যবহৃতই থেকে যেত, যার ব্যবহার কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছিল না তাই বাধ্য হয়ে বাবা আমার অপারেশন করে আমার মাথায় চিপস বসিয়ে দেন।
সবাই যার যার মেধা আর স্মৃতি শক্তির ব্যবহার করে যাচ্ছে আর আমি স্মৃতি শক্তির পরিবর্তে চিপসের সাহাজ্যে ইন্টারনেট থেকে ডাটা নিয়ে সেটাই ব্যবহার করে যাচ্ছি।
কী এমন হতো আমি আজীবন মুর্খ থেকে গেলে, কিংবা ক্লাসের
সেই আদু ভাই থেকে গেলে?