আজ আমার দেশীয় চাকরী জীবনের শেষ দিন…


এই অসাধারণ মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই একধরণের খারাপ লাগা অনুভূতি কাজ করছে। কিন্তু না গিয়েও উপায় নেই। যারা আমার পিছনে এতোটা ইনভেস্ট করে গেল, তাদের তো অন্তত ফিরিয়ে দেয়া যায় না। 
অফিসে ঢুকতেই একধরণের হাহাকার অনুভব হলো, এই অফিস, অসাধারণ মানুষগুলোকে আমার ছেড়ে যেতে হচ্ছে। আমি বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। অনেকাংশে সফল হলেও ভিতরে ভিতরে বড়োসড়ো ঝড় তোলপাড় করছে।
সবাই আসার পর যথানিয়মে অফিস শুরু হওয়ার কথা থাকলেও, কারোরই সেদিকে খেয়াল নেই। সিইও সাহেব স্মোক জোন এ পড়ে আছেন, বরূণা স্পোর্টস কর্ণারে, অনামিকা মেয়েটা বসে আছে রিডিং রুমে, সুনীল আসেই নি। কী একটা অবস্থা! ক্লায়েন্ট ডেডলাইন দিয়ে বসে আছে অথচ আমাদের কারোরই কাজের দিকে মনোযোগ নেই। যদিও আজকের পরে আমার দায়-দায়িত্ব থাকছে না তারপরেও আজকের দিন পর্যন্ত অন্তত কোম্পানি আমার রেস্পনসিবিলিটি এক্সপেক্ট করে।

‍‌‌‌‌~

চাকরীতে জয়েনের পর অনেকেই একজন জুনিয়রের ৬ ডিজিটের স্যালারি সুন্দর ভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাই প্রথম প্রথম অনেকেই আমাকে যার যার দিক থেকে হিংসে করা শুরু করে দিলো। আমি যথাসম্ভব স্কিপ করে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখলাম। মাত্র ৬ মাসের জন্য কী দরকার হুদাই মানুষের সাথে ঝামেলা বাধানোর। আমি আমার মতো কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। একবার কোম্পানির একটা পুরাতন প্রজেক্টে বাগ ধরা পড়লে কোম্পানি সেটার হটফিক্সে লেগে রানিং প্রজেক্টে পিছিয়ে পড়তে লাগলো। কারণ সেই প্রজেক্টের কোনো ডেভেলপারই কোম্পানিতে বর্তমান ছিলেন না। আর যারাই কাজ করছেন তাদের সবারই কোড পড়ে পড়ে কাজ করতে হচ্ছে। আমি তখন একেবারেই নতুন তাই সিনিয়ররা একজন জুনিয়রকে এতো বড়ো প্রজেক্টে রাখতে তাদের ইগোতে লাগছে বা তারা চাননি কোনো জুনিয়র এতো প্রেশার নিক নতুবা হিংসে থেকেই আমাকে অব্যাবহৃত রেখে দিলেন। ২১ দিনের মাথায় সিইও সাহেব বিস্তারিত জানতে পেরে সিনিয়রদের বকাঝকা করে আমার সাথে আরো দু’জন দিয়ে বাকি সবাইকে বর্তমান প্রজেক্টে লাগিয়ে দিলেন। আমি জানি না সিইও আসলে এতো সাহস কেমনে করলেন। নাকি ৬ ডিজিটের স্যালারির প্র্যাক্টিকাল টেস্ট নিলেন সেটাও বুঝলাম না। সে যাই হোক আমার সাথে একজন সিনিয়র একজন জুনিয়র এবং আমি। আমিও অবশ্য জুনিয়র বটে।
আমার চিপসের ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই ডাটা অনলাইনে রাখতে হবে, অফলাইন থেকে ডাটা নিয়ে সেটা প্রসেস করতে আমার অনেক সময় লেগে যায়। অনলাইনে যেটা আমি এক মিলিসেকেন্ডেরও কম সময়ে করতে পারি সেটা অফলাইনে করতে গেলে আমার প্রায় ১০০ মিলিসেকেন্ড বা তারও বেশী সময় লাগে।
তাই পুরো প্রজেক্ট একটা এসবিএন সাইটে আপ করে দিলাম দায়িত্ব পাওয়ার সাথে সাথেই। আমার সিনিয়র আমার সাথে পারলে বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে ফেলেন। আমি তাকে বললাম ভাই একটা কফির ব্যবস্থা করেন আমি বাকিটা দেখতেছি। তিনি রীতিমতো অপমানবোধ করলেন সেই সাথে টাট্টা মশকরা করতেও ভুল করলেন না। আমি ওসবে কান না দিয়ে আমি আমার কাজ করে যেতে লাগলাম। পুরো প্রজেক্ট আপলোড হওয়ার পরে পিওনকে কফি দেয়ার কথা বলে আমি পুরোটা পড়ে নিলাম। কফি খেতে খেতে সিনিয়র ভাই জিজ্ঞেস করলেন তোমার কাজের আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। আমরা হটফিক্স করতেছি এটা তোমার মাথায় থাকা দরকার। এখানে যত কম সময় খরচ হবে ততই আমাদের লাভ। আমি হেসে হেসে উত্তর দিলাম ভাই রিলাক্সে কাজ না করলে আমি কাজের কোয়ালিটি ধরে রাখতে পারি না। আমি উনার সাথে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছি আর ওদিকে ফাইলগুলো পড়ে নিচ্ছি। ফাইল পড়া শেষ হওয়ার পরে বললাম চলেন ভাই কাজ শুরু করা যাক। আমার সাথে যে জুনিয়র ছিলো তাকে বললাম তুমি এক কাজ করো, তুমি বসে থাকো আর দেখো কেমনে হটফিক্স করতে হয়। আমার সিনিয়রকে ৭ টা মড্যুল ধরিয়ে দিয়ে বললাম আপনি জাস্ট এই ৭ টা চেক করেন বাকি পুরো প্রজেক্ট আমি দেখতেছি। তিনি রীতিমতো অপমানবোধ করলেও বিষয়টা আপাতত স্কিপ করে গেলেন, যাতে পরবর্তীতে তিনি মশকরা করতে পারেন। উনার অগ্নিমূর্তি চেহারারভাব দেখে আমি জুনিয়রকে সাথে নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম ঘুরতে।
দুদিন পর সিইও সাহেব জানতে চাইলেন তার হটফিক্সের কী খবর। আমি সিনিয়র ভাইকে জিজ্ঞেস করলে পরে তিনি জানালেন তার আরো একদিন লাগবে। সিনিয়রের কাছ থেকে এসে সিইও কে জানিয়ে দিলাম আমরা কালকেই কাজ ডেলিভারী দিচ্ছি। আমার জুনিয়র আমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে দেখলো। সেও মোটামুটি ট্রল করার একটা প্রিপারেশন নিয়ে রাখলো সম্ভবত। একে তো তাকে কিছুতেই হাত দিতে দেইনি। আবার সিনিয়রের সাথে খুব ভালো একটা ব্যবহারও দেখাইনি। তার উপর আবার আমার বেতনটা এমনিতেই সবার হিংসে। সবমিলিয়ে সবাই আমার দিকে খ্যাপে আছে।
– “যদি মাইন্ড না করেন আমি কাজটা করতেছি” আমি সিনিয়র ভাইকে বললাম 
– “তোমার কাজ শেষ?” উনি বললেন।
– “হুম আমার শেষ, আপনার টা শেষে ডেলিভার করে দেব।”
– “তাহলে তুমি রেস্ট করো আমি করতেছি।”
– “সমস্যা নাই আমি করতেছি, আপনি রিলাক্স করেন।”
– “ঠিক আছে তুমি করো আমি দেখি” বলে উনি আমার পাশে বসলেন। আমি একটার পর একটা ফিক্স করতেছি আর উনি আমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছেন। ৪০-৪৫ মিনিটের মাথায় সব শেষ করে আমার টিম নিয়ে মুভি দেখতে গেলাম।
এই প্রজেক্টের কাজ ডেলিভার করার পর, আমার কাজ প্রায় সবার তুলনায় শতগুনে বেড়ে গেল। জুনিয়র সিনিয়র সবারই আমার প্রতি একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়ে গেল। তারপর কারোর কোনো কোডে এরর দেখা দিলে আমার কথাই সবার মনে পড়তো। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করতাম সবাইকে হেল্প করার।
মানুষগুলো কী সুন্দর নিজের মাথার ব্যবহার করে যাচ্ছে, নিজের আইডিয়া ইমপ্লিমেন্ট করে প্রবলেমে পড়তেছে আবার সলভ করতেছে, আর আমি…..
একটা চিপস নিয়ে জগতে সুপার হিউম্যানের ভূমিকা পালন করে করে মানুষের ভালোবাসা কুড়াচ্ছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জগতে চলাফেরা করছি আর মানুষের বাহবা কুড়াচ্ছি।

~

গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পর আমার আইবিএমে জয়েন করার দিন তারিখ নির্দিষ্ট হলে পরে আমি সিদ্ধান্ত নেই কোথাও এক জায়গায় কয়েকদিনের জন্য ইন্টার্নিতে ঢুকে হালকা-পাতলা একটু এক্সপেরিয়েন্স নেব।
দেশের বেশ কয়েকটা কর্পোরেট অফিসে যোগাযোগ করলে পরে অনেকেই ফ্রেশার নিতে আপত্তি তুলেন। বিভিন্ন নীতিবাক্য শুনিয়ে আমাকে বিদায় করে দেন, এতে আমার নিজের জন্য একটুও মনখারাপ হয়নি। শুধু এটা ভেবেই মনখারাপ হতো যে, আমার তো চাকরি কনফার্ম আমার সাথে যারা গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে তাদের কী হবে? এই এতো এতো গ্র্যাজুয়েটরা যাবে কোথায়? আর তারা এক্সপেরিয়েন্স-ই বা নিবে কোত্থেকে? একাডেমিক পড়ালেখা নামক জীবন নষ্টের কারখানা থেকে বেরিয়ে এরা যাবেই বা কোথায়?
স্রষ্টা কাউকে না খাইয়ে রাখেন না সেটা যেমন সত্য তেমনি স্রষ্টা এমনি এমনিও কাউকে কিছু খেতে দেন না। সবার স্রষ্টা এক তবু একেকজনের অংক একেক, বুঝি না ওসব।
যতই দিন যাচ্ছে আমার জয়েনিং এর দিন তারিখ সামনে আসতেছে আমার এক্সপেরিয়েন্স নেয়ার আকাঙ্খাটা আকাঙ্খাতেই থেকে যাওয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কোম্পানি পাসপোর্ট এর কপি দেয়ার দিন তারিখও জানিয়ে দিয়েছে।
হুট করে কর্পোরেট লাইফে ঢুকে পড়া তাও সম্পূর্ণ অচেনা একটা দেশে অচেনা একটা পরিবেশে ব্যাপারটা অনেকাংশে আমার কাছে আন-ইজি লাগতেছে। শেষমেষ প্রথম যেই কোম্পানি থেকে রিজেক্ট খেয়েছিলাম সেখানে আবার গেলাম, আবার একি কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটলে আমি তাদের জানালাম আমি আপনাদের এখানে মাত্র ৬ মাস থাকব। তারপরেই আমার আইবিএমে চাকরি কনফার্ম বলে সব কাগজপত্র, এগ্রিমেন্ট, সহ আরো যা আছে সব সামনে তুলে ধরলাম। এটা দেখে আশ্চর্য্য হতে হলো যে আমার কাগজপত্র দেখে সাথে সাথেই আমাকে ৬ সংখ্যার একটা সেলারি অফার করে বসলো। সেই সাথে লম্বা একটা চুক্তির কথাবার্তার দিকে এগুতে লাগলো। আমি তাকে সেই সুযোগ না দিয়ে আমি আমার ৬ মাসের হিসেবেই কথাবার্তা আগাতে লাগলাম। সব কথাবার্তা শেষ করে সেদিনের মতো চলে গেলাম, এবং কথা হলো মাসের মাঝখানেই আমার জয়েনিং, যেদিন থেকেই আমি শুরু করতে চাই সেদিন থেকেই পারব, আগেরদিন জানিয়ে দিলেই হবে।
আমিও চান্সটা আর মিস করতে যাইনি, পরদিন থেকেই জয়েন করব বলে সেদিনের মতো চলে আসলাম এবং পরদিন থেকেই ডিউটিতে লেগে গেলাম।

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.