এটা কোনো পাঠপ্রতিক্রিয়া বা কথিত বই রিভিউ না, বই নিয়ে ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলা-ই বোধ করি শ্রেয় হবে
শুরুর আগে…
নগরীর শাকিল বুক সেন্টারে বসে আছি, হঠাৎ খেয়ালে পড়ল; গরীবের হাজী মহসিন খ্যাত কবি, সাহিত্যিক, গবেষক, আলুরচপ, সমালোচক, গায়ক, নায়ক, লেখক, সম্পাদক, ‘শ্রদ্ধেয় বড়ো ভাই’, জনাব সাখাওয়াত হোসেন সাকিল ওরফে সিলটী সাকিল একটার পর একটা বই পছন্দ করে ক্যাশের দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন আর মহাজন সাহেব ক্যালকুলেটরে হিসেব কষতেছেন। বুঝতে বাকি রইল না, আজ গরীবের হাজী মহসিন নিজেই নিজের পকেট কাটতেছেন। আমিও মানবতার স্বার্থে তার পকেট কাটায় এগিয়ে আসলাম। বইটা হাতে নিয়ে ক্যালকুলেটরে হিসেব উঠিয়ে নিজ দায়িত্বে নিজের ব্যাগে নিয়ে নিলাম।
হতাশ হতে হয়নি- বইটার মালিকানা পেয়ে গেলাম। এবার সময় করে পড়ার পালা।
বইয়ের ভুমিকা, লেখকের কথা, প্রকাশকের কথা, অনুবাদকের কথা এইসব হাবিজাবি পড়া আমার ধৈর্যে ধরে না। এইসব স্কিপ করে গিয়ে পড়লাম মহা ঝামেলায়, প্রায় অনেক পৃষ্ঠা পড়ার পরেও আমি বইয়ের ভেতর ঢুকতে পারতেছি না। একটা সারমর্ম নির্ধারণ করতেও পারতেছি না আবার আগ্রহও ধরে রাখতে পারতেছি না। তারপরেও কোনোরকমে সামান্য আগ্রহটুকু ধরে রেখে বইয়ের ভেতরে থাকা বইটা পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম…
এবার শুরু হলো থ্রিলিং পর্ব। এরা কি সব কথাবার্তা বলে?
না! বইটা কোনো থ্রিলার ঘরানার বই না। আবার রোমান্টিক বা পুতুপুতু টাইপ কোনো প্রেমের গল্প না। নাম দেখে হয়ত অনেকেরই এমন একটা চিন্তা আসতেই পারে, চল্লিশ রুলের একটা বাস্তব জীবনে অ্যাপ্লাই করতে পারলেই……
এটা প্রেমের কোনো বই না, যেটা কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পরেই জানতে পারবেন। তবে এটাতে প্রেম বা ভালোবাসা অবশ্যই আছে, কিন্তু সেটা আমাদের চলমান বা সরল অর্থে যে প্রেম বুঝি সে প্রেম নয়, প্রকৃতি, সৃষ্টিকর্তা আর মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসার গল্প। এটাকে ফিলোসফিক্যাল জনরার বই বললেই বোধকরি বেশি উপযুক্ত হবে।
বইটা পড়ছি অবাক এক বিস্ময় নিয়ে। শুধুমাত্র কাহিনী নয়, বিভিন্ন সময়ের কাহিনীর ব্লেন্ডিং নিয়ে। ইতিহাসের সুফি রুমি আর বোহেমিয়ান দরবেশ শামস তাবরিজি-র জীবনের সাথে আধুনিক যুগের এক আমেরিকান নারী এলা আর ডাচ পুরুষ আজিজের কাহিনী, যেন তিনটি গল্প একত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। একবার ভাবছি আমি কি “ফোর্টি রুলস অফ লাভ” পড়ছি নাকি একই সাথে কোনো সিরিজ বই! বইটি কি এলিফ শাফাক লিখেছেন নাকি আজিজ যাহারা! দুইটা সময়ের গল্প পাশাপাশি এগিয়ে যাওয়ার গল্প আগে যে পড়িনি তা নয়, কিন্তু তবুও আমার মনে হয়েছে, আমি সম্পুর্ণ একটা ভিন্ন ধাঁচের লেখার সাথে পরিচিত হলাম।
অনেক হইছে, এবার একটা নোট যোগ করি:-
“আমার পরিচিত মানুষগুলাের মাঝে প্রায় সবার জীবনেই অন্তত একজন এমন
মানুষ আছে যাকে সে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দিতে পারলে খুশি হয়।
যদিও তারা সাধারণত এমন কিছু করে না, তাই বলে তাদের মন থেকে খুন করার ইচ্ছেও যে গায়েব হয়ে গেছে সেটা ভাবলে ভুল হবে। সত্যি কথা বলতে, প্রত্যেকের মাঝেই খুন করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু খুনটা করে বসার আগ পর্যন্ত মানুষ সেটা বুঝে উঠতে পারে না। সবাই ভাবে, তাদের পক্ষে খুন করা সম্ভব নয়। কিন্তু একটা খুন হচ্ছে কয়েকটা কাকতালীয় ঘটনার সমষ্টি মাত্র। কখনও কখনও সামান্য একটি অঙ্গভঙ্গির কারণেই কারও মাথায় খুন চড়ে যেতে পারে। কোনাে ইচ্ছেকৃত ভুল বােঝাবুঝি, অর্থহীন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি, অথবা স্রেফ ভুল সময়ে ভূল জায়গায় উপস্থিত থাকার কারণেই মানুষের মাঝে জেগে উঠতে পারে ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তি। অথচ এমনিতে হয়তাে
তারা সাদাসিধে, নিপাট ভালাে মানুষ।
যে কেউই খুন করতে পারে। তবে একজন আগন্তুককে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার ক্ষমতা সবার থাকে না।”
আমারও এমন একটা অদ্ভুত ইচ্ছে আছে, কেউ একজনকে ভালোমতো প্যাদানি দেয়ার। খুন করব না। তবে ভালোমতো প্যাদানি দেয়ার ইচ্ছে আছে। প্রায়ই মানুষজনের সাথে শলাপরামর্শ করি, কেমনে কি করা যায়! অবশ্য আমার টার্গেটেড ব্যক্তির সাথেও এ নিয়ে শলাপরামর্শ করা হয়েছে। তাকে এ-ও বলেছি- যে আমি তাকেই প্যাদানি দিতে চাই। সেই সাথে- তার চারুলতা, আনন্দিতা সবার সাথেই আলাপ হয়েছে যে, আমি একজনকে প্যাদানি দিতে চাই।
আমি কিন্তু সাকিল ভাইয়ের নাম বলিনি। ঠিকাছে?
চল্লিশ নিয়মের একটা নিয়ম-
“ভালোবাসা ছাড়া একটি জীবনের কোন মূল্যই নেই। তোমার কোন ধরণের ভালোবাসা প্রয়োজন; আধ্যাত্বিক নাকি ব্যক্তিগত, স্বর্গীয় নাকি জাগতিক, পশ্চিমা নাকি প্রাচ্যিয় – সেটা জিজ্ঞেস করো না। বিভেদ শুধুই আরো বিভাজন তৈরি করে। ভালোবাসার কোন নাম নেই, কোন সংজ্ঞা নেই। এটা সে রকমই, যে রকম তুমি দেখছ, এর কম/বেশি আর কিছুই নয়।”
মসনবি শরীফের শুরু হয়েছে আরবি ‘বা’ বর্ণ দিয়ে। মূল বইতে এলিফ শাফাক তার প্রতিটা অধ্যায় শুরু করেছেন ইংরেজি ‘বি’ বর্ণ দিয়ে। শাহাদুজ্জামান তার অনুবাদেও একই কাজটা করে গেছেন। প্রতিটা অধ্যায় শুরু করেছেন বাংলা ‘ব’ বর্ণ দিয়ে।
এলিফ শাফাক তার উপন্যাসের প্রত্যেকটি অধ্যায়ে সব চরিত্র আত্মকথনের মাধ্যমে নিজেদের সুখ-দুখ-বুঝ বিবেচনা প্রকাশ করেন। এতে দেখা যায়, জগতের বা বিভিন্ন সমাজের একটা সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরবার প্রয়াস আছে। ধনাত্মক ও ঋণাত্মক সমাজবাস্তবতার বিচিত্রতা, বিভিন্নতা-যে, মূলত একটা সামগ্রিক বাস্তবতারই দ্যোতন বা জ্ঞাপন, সেই ব্যাপারটাও স্ফুট বিভিন্ন অধ্যায়ে।
থাক! অনেক বলে ফেলেছি। আর কথা দীর্ঘ না করি। সময় বের করে পড়ে ফেলুন…